Friday, February 14, 2014

প্রেমের সকাল দুপুর রাত্রি -১

Protected by Copyscape Originality Checker

আমার নাম মীরা। এই নামটা মা রেখেছিলেন। জীবনের এই সায়াহ্নে এসে নিজের নামটা খুব অর্থপূর্ণ মনে হয়, হাসিও পায়; মা কি আগে থেকেই সব জানতেন? উনি বেঁচে থাকলে হয়তো জিজ্ঞেস করা যেতো কিন্তু এখন সে উপায়ও তো নেই।

আশে-পাশের আর দশটা ষোড়শীর মতো আমিও যে প্রেমে পড়তে চাইনি, চুপি চুপি ভালবাসতে চাইনি, সাইকেলের সীটের সামনে বসে গঙ্গার ধারে যেতে চাইনি, রক্তে লেখা চিঠি, ডেয়ারি-মিল্ক, একটি সদ্য ফোটা লাল গোলাপ, কিংবা নিদেন পক্ষে একটি archies gallary কার্ড চাইনি কোনদিন, এমন নয়। সুন্দরী যে ছিলাম না, এমনও নয়। লোকে বলতো, আমার রুপে নাকি দশদিক ঝলসে যেত, যেন রুপ নয় আগুন। কি আশ্চর্য, ওই লোকেরাই আবার আড়ালে আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে বলতো, ঝলসে দেওয়া আর আলো করার মধ্যে অনেক তফাত আছে। ওই যে কথায় বলে না, অতি বড় সুন্দরী পায় না বর!

কিন্তু মধ্যবিত্ত বাঙালি বাবা-মা রা তাঁদের ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন, ওরই মাঝে সময় পেলে টুকটাক কিছু গান-বাজনা, তবলা অথবা রবীন্দ্র-নৃত্য কিন্তু প্রেম? নৈব নৈব চ! তবে সারাদিন গানবাজনায় কাটালেও দিনের শেষে ঘরের ছেলেমেয়ে ডাক্তার বা এঞ্জিনিয়ারই হোক, এটাই ওঁদের স্বপ্ন হয়ে থাকে। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মাধ্যমিকে রাজ্য-স্তরে টপার হয়ে, সবাইকে খুশি করার জন্য বিজ্ঞান নিয়ে যখন পড়বো ঠিক করলাম, ততদিনে আমার নিজের মধ্যেও এক বিজ্ঞ-বিজ্ঞ ভাব এসে গিয়েছিল। কাউকে পরোয়া করার কথা ভাবতাম না, প্রেম কে তো নয়-ই। তাও মাঝে মধ্যে হৃদয়ের কোন অচেনা ভাঁজে যদি ভালো  লাগার কোন অনুভুতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করতো, রসায়ন, ভৌত-বিজ্ঞান অথবা অঙ্কের মোটা বইগুলি দিয়ে এক বাড়ি মারতেই অনুভূতিগুলো সব চুপটি মেরে বসে থাকতো। ওদের বলতাম, তোরা কোথাও লুকিয়ে থাকিস, এখন তোদের দেখা-শোনা করার মত সময় আমার কাছে নেই। বাধ্য শিশুর মত ওরা আমায় অনেকদিন আর বিরক্ত করেনি, বা করলেও আমি খেয়াল করিনি, তখন আমার ধ্যানজ্ঞান ছিল শুধু পড়ার বই আর র‍্যাঙ্ককিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে অনুভুতিগুলো কে এভাবে দমিয়ে রাখা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, কোনদিন সম্ভব হয় নি। ওরা নিজের মতো করে আসে, চলে যায়, ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে, কখনো বা চোখের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে।

উচ্চশিক্ষার জন্য যখন বাইরে গেলাম, তখন প্রথম বারের মতো অনুভুতিগুলিকে নিজের মতো করে খেলা করতে দিলাম। University ক্যান্টিনে দেখা হয়েছিলো ওর সাথে। মোহাম্মাদ হায়দার-সুদূর পাকিস্তানের বাসিন্দা, লম্বায় প্রায় ছয় ফুট, গায়ের রং গোলাপি, আর কথা বলতে পারতো অনর্গল, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু এবং বাংলায়। হায়দার তখন আসাম ইউনিভার্সিটিতে উর্দু ভাষায় গবেষণারত। সত্যি বলছি, সেই প্রথম দেখাতেই হায়দারকে নিজের বেণীমাধব বলে মনে হয়েছিলো। শরীরী আকর্ষণ যে একটা ছিল না অস্বীকার করছি না, কিন্তু তার চেয়ে বেশি যেটা আমায় কাছে টেনেছিল সে ছিল ওর উর্দু কবিতা।


ঘণ্টার পর ঘণ্টা ও কবিতা পাঠ করে যেতো আর এক-একটা শব্দ যেন তীরের মতো আমার গায়ে এসে বিঁধে যেতো যখন ও আমির খুসরু কিংবা গালিবের কবিতাগুলি বাংলায় অনুবাদ করে আমায় শোনাত,  আমি শুধু ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম অবাক হয়ে, হয়তো ভাবতাম... ভাবতাম অনেক কিছুই। সেসব বলতে গেলে একটা বই লেখা হয়ে যাবে। তবে আরেক কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ হওয়ার ক্ষমতা আমার মধ্যে হয়তো ছিল না। ভুল বললাম। আমার মধ্যে ছিল কিন্তু মীরা সেনগুপ্তের মধ্যে ছিল না।  

(চলবে)